সিলেট নিউজ বিডি ডেস্কঃ ১৯৭২ সালে কোটা ব্যবস্থা চালুর পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা ছিল। পরবর্তী সময়ে একই কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সেই কোটা বরাদ্দ করা হয়। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিমাণ। এবারের আন্দোলনেও বারবারই উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টিই।
“কোটার উদ্দেশ্য হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা অসম আছে কি না এটা একটা বিষয়,” বলেন সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এছাড়াও প্রতিবন্ধী বাদে অন্য কারো জন্য প্রয়োজন আছে কি না- এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি। এসময় কোটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নির্বাহী ক্ষমতার প্রসঙ্গও টানেন মি. খান। তিনি বলেন, “এটা কি সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার বিষয় না আদালতের বিষয়? ব্যক্তির অধিকার যদি ক্ষুণ্ণ হয় কিংবা সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটলে সেটা আদালতের বিষয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে বলে মনে হয় না। আগেতো নির্বাহী আদেশেই (কোটা) দেয়া হয়ছিল, আর নির্বাহী আদেশেই তা তুলে নেয়া হয়েছে।”
মোটাদাগে কোটা ব্যবস্থাকে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই বলেই মত বিশ্লেষকদের।
যেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কোটা রাখা হচ্ছে তা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে এবং কতটা কাজে লাগছে– সে বিষয়টাতেও নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান।“কোটা একটা পরিবার কয়বার ব্যবহার করতে পারবে? পশ্চাৎপদ কোনো পরিবারের একজন একবার চাকরি পেয়ে গেলে সে আর পশ্চাৎপদ থাকছে না। এছাড়াও পশ্চাৎপদতার আয়ের সিলিং থাকতে হবে। সব মিলিয়ে কোটা থাকবে কিন্তু কীভাবে পরিচালিত হবে ওটা নিয়ে অনেক ভাবনার বিষয় আছে,” বলেন তিনি।
ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে ছাত্র সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে অগ্রগন্য। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সকল শৃঙ্খল, অন্যায়-অবিচার ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তির সুতিকাগার হয়ে উঠেছে ছাত্র আন্দোলন। এই লেখাটিতে চলমান আন্দোলনসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের কয়েকটি সফল ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো—
১৯৫২ ভাষা আন্দোলনঃ
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা । ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এই অঞ্চলের ছাত্রসমাজই প্রথম অনুধাবন করেছিলো আমাদের প্রকৃত মুক্তি হয়নি। শোষনের জাল বিস্তার করে আছে চতুর্দিকে। দেশভাগের মাত্র সাত মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ বাংলার ছাত্রসমাজকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মাঠে নামতে হয়। ওই সময় মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের পুলিশ বাহিনীকে উপেক্ষা করে মিছিল করেছিলো ছাত্ররা। এই প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গড়ে তোলে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবি মেনে চুক্তি স্বাক্ষর করেন সেই নাজিমুদ্দিন বাঙালি জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেন। আর তাতেই গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিলে নামে তারা। দেশের ছাত্রজনতা যোগ দেয় মিছিলে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে মিছিলে গুলি বর্ষণ করে পুলিশ তাতেই নিহত হয় রফিক, শফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরো কয়েকজন। শফিউর ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যার ফলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। চাপের মুখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় সরকার।
১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলনঃ
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের উত্তাল ঢাবি ক্যাম্পাস। ক্ষমতা দখলের মাত্র দুইমাসের মাথায় অর্থাৎ ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইয়ুব খান শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্টে শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে । এই রিপোর্টে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সকল প্রস্তাব ছিলো তাতে আইয়ুব খানের ধর্মান্ধ, ধনবাদী, রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা সংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল। এই নীতিতে শিক্ষা স্তরে বৈষম্যসহ উচ্চশিক্ষা ধনিক শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত হয়েছিলো। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্বশাসন থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের নেয়া, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের উপর তীক্ষ্ন নজর রাখা ছাড়াও শিক্ষদের কর্মঘন্টা ১৫ ঘন্টা করা হয়। রিপোর্টে বাংলা ও উর্দু হরফের পরিবর্তে রোমান বর্ণমালা ব্যবহারেরও প্রস্তাব তরা হয়।
আইয়ুব খান এই কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বর্ণনা করেন। এই রিপোর্টে তার সাম্প্রদায়িক চেতনা আরো প্রকটিত হয়। এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে ১৯৬০ এবং ১৯৬১ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে বাধা আসে। তারপরও পালিত হয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে ফেব্রুয়ারি জুড়ে আন্দোলন চাঙা থাকে। ছাত্র ধর্মঘট, রাজপথে মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশের মতো কর্মসূচি চলতে থাকে। ছাত্রদের প্রতিহত করতে পুলিশের পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করা হয়। বসানো হয় ফিল্ড কামান। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে পুলিশ বেষ্টনিতে আটকতা পড়া শিক্ষার্থীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। আর ছাত্রসমাজ জড়িয়ে পড়ে আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরোধী আন্দোলনে।
জুনে দিকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল স্কুল, ন্যশনাল মেডিকেল ইনিস্টিটিউটসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আগস্টে ছাত্র ধর্মঘট ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলন পরিণতির দিকে যায়। দেশব্যাপি হরতাল পালিত হয়। ছাত্রদের সাথে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। হরতালের মিছিল নবাবপুরের দিকে যাওয়ার সময় পিছন থেকে আক্রমন করে পুলিশ ও ইপিয়ার। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছাড়াও তার গুলি চালায়। পুলিশের সাথে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষ ঞয় কোর্ট এলাকায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তিন জন। বাবুল গোলাম মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ। আহত হন আরও অনেকে। গ্রেফতার হয় শত শত শিক্ষার্থী। সরকার শ্রেফ এক বিবৃতি দিয়ে ধামাচাপা দেয় প্রকৃত ঘটনার।
১৯৬৯ গণঅভ্যূত্থানঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। আর মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত গভর্নর হাউস ঘেরাওয়ের মাধ্যমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠন করা হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ যারা ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সাথে ছাত্রদের সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি দাওয়া এবং কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থকেন্দ্রিক দাবিসমূহ অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সময়োপযোগী এই পদক্ষেপের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টিও সামনে আসে।
সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফুসে উঠা জনগণ ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা ও প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি হাতে নেয়। এ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদউজ্জামান নিহত হলে গণজাগরণ রূপ নেয় গণঅভ্যূত্থানে। ২৪ জানুয়ারি গুলিতে নবম শ্রেনির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে নিহত হলে পরিস্থিতি সরকারের নাগালের বাইরে চলে যায়। সরকার সেনাবাহিনীর উপর শহরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। গণঅভ্যূত্থানের শেষ প্রভাবক হিসেবে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন এই গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এতে করে গণঅভ্যূত্থান কিছুটা স্তমিত হলেও তৈরি হয় নতুন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা।
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধঃ
যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে কতিপয় ছাত্র। সাল ১৯৭১ বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বিজয় এসেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। অন্যান্য সকল আন্দোলনের মতো মুক্তিযুদ্ধেও ছিল ছাত্রদের সরব ভূমিকা। স্লোগান দেয়া থেকে শুরু করেে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবেলা কি করেনি ছাত্র সমাজ।
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া খান ২ মার্চ হতে যাওয়া গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলা। ২ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক জনসভায় প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই সময় ছাত্র ইউনিয়নও এক অভিন্ন জনসভা করেন। ৩ থেকে ৬ মার্চ ছাত্ররা পরীক্ষা বন্ধ রেখে হরতাল পালন করে।
সে সময়ের নামকরা ছাত্র নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিকবাহিনী প্রথম আক্রমন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উপর। যার ফলে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং সংশস্ত্র সংগ্রামে জনগণকে লিপ্ত হতে উৎসাহ দেয়। যুদ্ধের নয় মাস ছাত্ররা সারা বাংলায় শত্রুর মোকাবেলা করার সাহস জুগিয়েছে। অসংখ্য ছাত্র সীমানা পেরিয়ে ভারত চলে গেছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে। ফিরে এসে লড়াই করেছে। রক্তের বিনিময়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে।
১৯৯০ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনঃ
রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ক্ষমতায় বসেই তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। ১৯৮৩ এবং ৮৪ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত হয় অনেক ছাত্রছাত্রী। এই ঘটনার পর থেকে এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।
১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদ নামক এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হলে সেই মৃত লাশকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সংগঠকরা। ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সমর্থনে গড়ে ওঠে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’। এর সাথে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। ছাত্র সংগঠনের মিলিত শক্তির সামনে সেনাবাহিনী কার্যকর কিছু করে উঠতে পারেনি। ছাত্রদের আন্দোলনে জনগণ সমর্থন দেয়া মাত্রই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এবং গণঅভ্যূত্থানের মুখে ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ইতিহাসে ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পুরোপুরি ছাত্রদের দৃঢ়তায় সফল হয়েছিল। সে সময় ছাত্ররা নিজ নিজ রাজনৈতিক নেতাদের আদেশ উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়েছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। পতন ঘটায় এরশাদের।
২০০৭ শিক্ষক মুক্তি আন্দোলনঃ
তত্ত্বাবধায়ক-সেনা শাসিত বাংলাদেশে জরুরি অবস্থার অজুহাতে যেখানে সেখানে ক্যাম্প করছে সেনা বাহিনী। ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্প করে সেনাবাহিনী। ২০ আগস্ট বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল খেলা চলছিল্ খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে ছাত্র ও সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায় সেনা বাহিনী। প্রতিবাদ করতে গেলে লাঞ্ছিত হন লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মোবাশ্বের মোনেম।
শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে ক্যাম্পাস। সেনাবাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সেনাদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি করা হয়। সে দাবি মেনে না নিলে ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি করা হয়। এই অবস্থায় ২১ আগস্ট নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে সকল শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে গুলি চালায় পুলিশ। নীলক্ষেত, টিএসসি, কার্জন হল এলাকার মো মো করে টিয়ার সেল আর রাবার বুলেটে। ২২ আগস্ট আন্দোলন দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়। সন্ধ্যার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
২৩ আগস্ট রাতে আটক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদকে। এছাড়া শিক্ষকদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করায় গ্রেফতার হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইদুর রহমান, আবদুস সোবহান, মলয় কুমার ভৌমিক, দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং সেলিম রেজা নিউটনকে।
কারফিউর রাতে এবং পরদিন আজিজ মার্কেট, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশনসহ যেখানে ছাত্র পেয়েছে শারীরিক নির্যাতন করেছে সেনাবাহিনী। ঘটনার দীর্ঘ ৬৬ দিনের মাথায় ক্যাম্পাস খুলে দেয়া হয়। ফিরে এসে আরো জোরালো দাবি তোলে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির । প্রবল চাপের মুখে সরকার আটকৃতদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২০১৮-২০২৪ ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনঃ
২০১৮ সালে এসে আবার গর্জে উঠেছে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বছরের প্রথমার্ধে শুরু হওয়া সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নামে ছাত্র সমাজ। সরকারের মিথ্যে আশ্বাসের সাথে যোগ হয় সরকারদলীয় ছাত্রলীগের হামলা। প্রকাশ্যে হামলা জঘন্য নিদর্শন প্রদর্শন করে তারা। পুলিশ এবং ছাত্রলীগের নির্বিচারে কোটা আন্দোলনকারীদের উপর হামলার কোন বিচারতো দূরের কথা উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় সরকার। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙ্গে দেয়া, নারীদের শ্লীলতাহানি, গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয়া, আহতদের বিনা চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার মতো ন্যাক্কারজনক কাজ করে ক্ষমতাসীনরা। এমনকি প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রাখেননি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ না হতেই রাজপথে নেমে আসে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাস চাপায় সহপাঠী নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে রাষ্ট্র মেরামতের কাজে হাত দেয় তারা। ফিটনেসবিহিন গাড়ি ভাংচুর, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহিন ড্রাইভারদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা ছাড়াও যানবাহনকে শৃঙ্খলিত করার দারুণ নিদর্শন প্রদর্শন করে তারা। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাগড়া সরকারের। নৌপিরিবহন মন্ত্রী হেসে উড়িয়ে দেন মৃত্যুর ঘটনা, পরিবহন বন্ধ রাখে তার সংগঠন। বিতর্কিত ‘চুমু’ খাওয়ার বাক্য ব্যবহার করেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী। ছাত্রলীগের উপর দায়িত্ব দেয় আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের আর তাতেই বিধি বাম। ছাত্রলীগ ফেরে তার চিরচারিত চেহারায়। স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমন চালায়। পুলিশও সহযোগিতার হাত বাড়ায়। ছাত্রলীগ পুলিশ যৌথ হামলায় আহতের সংখ্যা অগণিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে দেশ।
ভয় নেই। আমাদের ছাত্র আন্দোলনের সফলতা ইতিহাস বদলে দেবার মতো। ইতিহাস বদলাবে। দেশে শৃঙ্খলা আসবে। একেকজন শিক্ষার্থী বারুদ হয়ে জ্বলে উঠবে। তাই ওদের সুরে বলতে চাই, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি ঘুরে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।