শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অর্ধশত হত্যা মামলা

সিলেট নিউজ বিডি ডেস্কঃ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সারা দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত অর্ধশত হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে সাতটি।
জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৫৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। নির্বিচারে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হচ্ছে। এর বেশিরভাগই হচ্ছে হত্যা মামলা। এ ছাড়া হত্যাচেষ্টা, নির্যাতনসহ নানা ফৌজদারি অপরাধে মামলাগুলো করছেন সংক্ষুব্ধরা।

গণহত্যার অভিযোগগুলোর ওপর তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত করছে থানা পুলিশ। এসব হত্যা ও গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুসহ অনেকেই আসামি হয়েছেন। আসামি করা হয়েছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, ব্যারপ্রধান, ডিবিপ্রধান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। পাশাপাশি সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার সাবেক এমপি এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অন্তত ১৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কালবেলার প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।

গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দুপুরে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর মুদি দোকানদার আবু সায়েদকে (৪৫) হত্যার অভিযোগ এনে এস এম আমীর হামজা নামে এক ব্যক্তি গত ১৩ আগস্ট সাতজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এটিই ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া প্রথম হত্যা মামলা।

এরপর ১৪ আগস্ট ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের নিহত শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজন হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের নামে মামলা করা হয়। এদিন শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গুম করে নির্যাতনের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা। ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি হত্যা মামলা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মাদ্রাসাছাত্র শিশু জোবাইদ হোসেন ইমনকে (১২) র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা এবং শেরেবাংলা নগরে অটোরিকশাচালক সাহাবুদ্দিন পুলিশের গুলিতে খুন হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে মামলা দুটি করা হয়।

১৬ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকার মিরপুরে মো. সিফাত হোসেন (২৬) নামে এক তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। এ ছাড়া বগুড়ায় সেলিম হোসেন (৪০) নামে এক শিক্ষক নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১০১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৪৫১ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে দুটি হত্যা মামলা হয়। এর মধ্যে আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আবুল হাসান স্বজন (২৫) নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা হয়। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এমপি শামীম ওসমানসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া কলেজছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী (১৯) নিহতের ঘটনায় তার চাচা মোহাম্মদ পারভেজ চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ৩৪ জনকে আসামি করা হয়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৮ আগস্ট ঢাকা, রংপুর, নাটোর ও জয়পুরহাটে আরও ৫টি হত্যা মামলা হয়। ১৯ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আরও ৬টি হত্যা মামলা হয়েছে।

২০ আগস্ট আন্দোলনের সময় ১০ জনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকা, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, ময়মনসিংহের ফুলপুর ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ১০টি হত্যা মামলা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঁচটি মামলা করা হয়। মামলাগুলোয় আসামির সংখ্যা ১৮০। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীতে একটি, মিরপুরে একটি, আদাবরে একটি, সূত্রাপুরে একটি এবং রামপুরায় একটি হত্যার ঘটনায় এসব মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে যাত্রবাড়ীতে করা মামলায় শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামও রয়েছে।

এরপর গত ২১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১০ জনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ১০টি হত্যা মামলা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় চারটি এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ফতুল্লা, ঢাকার আশুলিয়া, উত্তরা ও চট্টগ্রামে একটি করে মামলা হয়েছে। ঢাকার পাঁচ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১১৬ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে শেখ হাসিনা, নজরুল ইসলাম বাবু, শামীম ওসমানসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে একটি এবং সিদ্ধিরগঞ্জে শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে আরও দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব হত্যা মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

গণহত্যার সাত অভিযোগ: ঢাকার সাভারে ডেইরি ফার্ম হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আরিফ আহমেদ সিয়াম আন্দোলনকারী ছাত্র হওয়ার কারণে আসামিদের নির্দেশে পুলিশ সদস্য কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় গত ১৪ আগস্ট সিয়ামের বাবা বুলবুল কবির শেখ হাসিনাসহ ৯ জন এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দাখিল করেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে নিহত মেহেদীর বাবা মো. সানাউল্লাহর পক্ষে গত ১৫ আগস্ট আরও একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়।

এরপর গত ৪ আগস্ট মিরপুরের দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নিহত শাহরিয়ার হাসান আলভীর (১৫) বাবা মো. আবুল হাসান গত ১৯ আগস্ট গণহত্যার তৃতীয় অভিযোগটি দায়ের করেন।

এরপর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার চতুর্থ অভিযোগটি দাখিল করেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজাহার চৌধুরী। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গুলি চালানোর ঘটনায় ২০ আগস্ট গণহত্যার অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। ২১ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক তিনটি অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় দাখিল করা হয়। তিনটির মধ্যে ঢাকার ঘটনা নিয়ে দুটি ও চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে অপর অভিযোগটি করা হয়েছে। এসব অভিযোগে বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নামও রয়েছে।

এদিকে গত ১৩ আগস্টের পর থেকে ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশে মামলা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে ৫ শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও নির্যাতনের অভিযোগে। এসব মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী আসামি হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৯ আগস্ট এক দিনেই অন্তত সাড়ে ৬ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ২১ আগস্ট আরও ১৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় আড়াই হাজার জনকে আসামি করা হয়।