সিলেট নিউজ বিডি ডেস্ক: তাওয়াক্কুল মুমিনের অন্যতম চারিত্রিক ভূষণ। এটি ইমানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো উপায়-উপকরণ ও পদ্ধতির ওপর একমাত্র ভরসা করা শিরকের নামান্তর। তাওয়াক্কুলের পূর্বশর্ত হলো সতর্কতা অবলম্বন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মপ্রচেষ্টা।
তাওয়াক্কুল শব্দটি আরবি ‘ওকালত’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো ভরসা করা, নির্ভর করা। কোনো কাজ বা বিষয়ে কারো ওপর দায়িত্ব দিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়াকে তাওয়াক্কুল বলে।
তাওয়াক্কুলের সম্পর্ক মূলত অন্তরের সঙ্গে। ইমাম আহমদ (রহ) বলেন, তাওয়াক্কুল অন্তরের কাজ। একে মুখের দ্বারা বলা কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বান্দার পক্ষ থেকে নিজ কাজের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে দেওয়ার নামই তাওয়াক্কুল।
মহান আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হবেন। (সুরা আত-তালাক :৩) ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রহ)-এর মতে, তাওয়াক্কুল দিনের অর্ধেক। (মাদারিজুস সালেকিন ২/১১৪)
তাওয়াক্কুলকারী প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হন। দুনিয়ায় এর বিনিময়ে অফুরন্ত রিজিকপ্রাপ্ত হন। রসুল (স) বলেন, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথাযথভাবে তাওয়াক্কুল করতে পারো, তাহলে তিনি তোমাদের তেমনিভাবে জীবিকা দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিদের জীবিকা দিয়ে থাকেন। পাখিরা খালি পেটে বের হয় আর দিন শেষে ভরা পেটে বাসায় ফিরে আসে। (সুনানে তিরমিজি :২৩৪৪) অন্যদিকে আখিরাতে সফলতা লাভ করে।
তিনি (স) আরো বলেন, আমার উম্মতের মধ্য থেকে ৭০ হাজার লোক বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করবে। তারা হলো সেই সব লোক, যারা মন্ত্র-তন্ত্র করায়নি, অশুভ লক্ষণ বিশ্বাস করেনি; বরং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা করেছে। (সহিহ বুখারি :৬২০২)
আমাদের সমাজে একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, তাওয়াক্কুল বলতে কোনো উপায় অবলম্বন না করে একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসাকে বোঝায়। অথচ উমর (রা) বলেন, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের অর্থ হলো, ‘তুমি জমিতে বীজ বপন করবে, তারপর ভালো শস্যের জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে।’
যুগে যুগে নবি-রসুলগণকে আল্লাহ তাআলা তাওয়াক্কুলের পাশাপাশি বিভিন্ন উপায় গ্রহণ করতে আদেশ দিয়েছেন। যেমন আইয়ুব (আ)কে রোগমুক্তির জন্য তার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে, মারিয়ামকে খেজুর পাড়ার জন্য কাণ্ডে নাড়া দিতে এবং মুসা (আ)কে পানির জন্য লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত করতে আদেশ করেছিলেন। (সুরা সাদ :৪২; সুরা মারইয়াম :২৫; সুরা আল বাকারাহ :৬০)
যেকোনো অসুস্থতা ও রোগ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সতর্কতামূলক উপায়-উপকরণ অবলম্বন তাওয়াক্কুলের নামান্তর। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারেও অনেকের মাঝে শিথিলতা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। কেউ কেউ এটাকে তাওয়াক্কুল ও তাকদিরের অন্তরায় বলে মনে করেন।
অথচ মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা) সিরিয়া সীমান্তের যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করতে গেলে তাকে মহামারি হিসেবে আবির্ভূত প্লেগ রোগের কথা বলা হলো। তা শুনে তিনি প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা) তাকে বললেন, আপনি কি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য থেকে পালিয়ে যেতে চাইছেন? ওমর (রা) জবাব দিয়েছিলেন, আমি আল্লাহর নির্দেশেই আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। কেননা, মহামারি আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
রসুল (স) বলেন, যখন কোনো জনপদে মহামারি দেখা যায় আর তোমরা সেখানে অবস্থান কর, এমতাবস্থায় কোনোভাবেই সেখান থেকে বের হবে না। আর বাইরে থেকে কেউ সেই স্থানে প্রবেশ করবে না। (সহিহ বুখারি :৫৭২৮)। অপর এক হাদিসে এসেছে, রসুল (স) বলেন, তোমরা সুস্থ উটগুলোকে অসুস্থ উট থেকে পৃথক করে রাখো।’ (সহিহ মুসলিম :৪২৩৫)।
কোনো ব্যক্তি সতর্কতার উপায় অবলম্বন ব্যতীত নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া আত্মহত্যার শামিল। ইসলাম ব্যক্তিকে সর্বাবস্থায় তার সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ (সুরা আল বাকারাহ :১৯৫)
বৈষয়িক যে কোনো বৈধ উপায়-উপকরণ সম্পন্ন করে মহান আল্লাহর ওপর সেটির ভালো সমাপ্তির জন্য নির্ভরশীল হতে হবে। রসুল (স)-এর এক সাহাবি উটের রশি হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, উটটির ব্যাপারে তিনি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেন। জবাবে রসুল (স) বলেন, উটটিকে ভালো করে বাঁধো, এরপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো। (সুনান আত তিরমিজি :২৫১৭)
করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরিধান করা, হ্যান্ড সেনিটাইজার বা জীবাণুনাশক দিয়ে হাত বারবার ধৌত করা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, সর্বোপরি রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শুধু তাওয়াক্কুল করা অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
লেখক : ড. মো. আবদুল কাদের
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া