গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান

সিলেট নিউজ বিডি ডেস্কঃ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সেকথা আরো এক বার প্রমাণিত হয়েছে এ মহামারি করোনাকালে। সংকটে যখন দেশের শিল্প, সেবা, রপ্তানি ও অন্য খাতের শোচনীয় অবস্থা সেই সময়ে গোটা জাতিকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কৃষি খাত।

লকডাউনের কারণে অন্য সব খাত ও প্রবাসী আয় হতে অর্থের যোগান ব্যাপক হ্রাস পায়। এ সময়ে কৃষি খাতের বর্ধিত আয়ের মাধ্যমে সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হওয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে অর্থনীতির অন্যান্য খাত জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে, সেখানে কৃষি খাত জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতি যে বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বুনিয়াদকে শক্তিশালী করেছে কৃষি খাত। আর এ কৃষি খাতকে যারা সচল রেখেছে, তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশই নারী।

নারীরা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ২১টি ধাপের মধ্যে মোট ১৭টি ধাপেই কাজ করে থাকেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন মতে, ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের সঙ্গে ৬৮ শতাংশ নারী কাজ করেন। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ঘরোয়া ও গ্রামীণ পরিবেশের হওয়ায় তারা সহজেই এ পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন। তাছাড়া বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের পুরুষরা অধিক উপার্জনের আশায় শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণে তাদের পারিবারিক কার্যাবলী নির্বাহ করার পাশাপাশি খাদ্য ও সামগ্রিক চাহিদা পূরণের জন্য নারীদের বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হচ্ছে। পশুপালন, মত্স্য চাষ, খামার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে।
এসব কাজে যুক্ত হওয়ার ফলে নারীরা যে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তা লক্ষণীয়। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির মধ্যে ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। যদিও এসব নারী শ্রমিকের সিংহভাগই অবৈতনিক পারিবারিক নারী শ্রমিক। যেসব নারীরা স্বাবলম্বী তারা শিক্ষা দিয়ে সন্তানের ভবিষ্যত্ গড়ছে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারছে, সব মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে নারীরা একটা বিশাল অবদান রাখছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর শ্রম আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিতে যোগ হয় কিন্তু তারা তাদের শ্রমের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তারা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিও পাচ্ছে না।

কৃষি খাতে প্রায় ৪৬ শতাংশ কাজই নারীরা করেন বিনা মূল্যে। ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের কাজের মূল্যায়ন কিংবা স্বীকৃতি সেভাবে করা হয় না। যার ফলে আমরা জাতীয় আয়ের যথার্থতা নিরূপণ করতে পারছি না। কৃষি থেকে প্রাপ্ত পারিবারিক আয়েও নারীদের ভাগ থাকে না। এটিকে তাদের প্রাত্যহিক ও পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়, যার কারণে শ্রমের মজুরি দেওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না।

শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী, ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে কৃষিঋণসহ সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা অধিকাংশ নারী কৃষকরা পায় না। এক্ষেত্রে নারীর নাম ব্যবহার করে পুরুষরা কৃষিঋণ তুললেও নারীদের কোনোরকম পরামর্শ তারা আমলে নেয় না। আবার কখনো নারীকে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়।
কৃষিতে সিংহভাগ অবদান রাখা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় মানসম্পন্ন সেবা, যথাযথ চিকিত্সা ও নির্দেশনা, প্রয়োজনীয় ওষুধ সঠিকভাবে পাচ্ছেন না নারীরা। স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত এসব সেবা গ্রহণের জন্য তাদেরকে পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের অনুমতি বা সম্মতি না পেলে সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় ঘরের কোনে। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন ও প্রান্তিক নারী কৃষি শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। তাদের ঋণের জন্য মহাজনদের কাছে ধরনা দিতে হয়। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কখনো কখনো সর্বস্বান্ত হতে হয়। এমন করে চললে কৃষিপণ্য উত্পাদনে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। গ্রামের নারীরা কৃষিক্ষেত্রে কাজের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

একটি দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে হলে তার শেকড় আগে শক্ত করতে হবে। আর আমাদের শেকড় হলো গ্রামবাংলা। মহিরুহরূপে আছে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও কার্যক্রম। এর ফলে আমরা জাতীয় আয়ের প্রবাহ দেখতে পাই। এই ফলকে অধিক পরিমাণে ফলাতে হলে আমাদের পুরুষদের কাজের পাশাপাশি নারীদের কর্মকেও মূল্য দিতে হবে। তবেই আমরা দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধশালী-আদর্শ রাষ্ট্রের রোল মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং বিশ্বের দরবারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব।

লেখক :মুমতা হেনা মীম
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়